ভালোবাসার শক্তিতে আমরা বেঁচে আছি : বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনা
আমরা প্রায়ই বলে থাকি , মানুষের মধ্যে হিংসা, স্বার্থপরতা বেড়ে যাচ্ছে, মায়া দয়া কমে যাচ্ছে, আজকাল কেউ কারো জন্য ভাবে না। মানুষের মধ্যে সহজাত নেতিবাচক অনুভূতি আগেও ছিলো, আছে ও থাকবেই। কিন্তু ঘৃণা কি ভালোবাসাকে ছাপিয়ে যেতে পারে , হিংসা কি সহানুভূতির অনুভূতির চেয়ে বেশি জোরালো? না, আমরা ঘৃণার চেয়ে বেশি ভালোবাসি, প্রতিহিংসার চেয়ে বেশি মমতা দেখাই । আসলে পারস্পরিক ভালোবাসার জোরেই মানব প্রজাতি Homo sapiens টিকে আছে। ভালোবাসা টিকে থাকার অন্যতম অবলম্বন। বিজ্ঞানীদের মতে, আমাদের বেঁচে থাকা সম্ভব হয়েছে কারণ আমাদের ভালোবাসা আছে. আমাদের আবেগ, অনুভূতি, সহানুভূতি ও মানবিকতা আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। আমার্ প্রতিপাদ্য বিষয়টি বিজ্ঞান নির্ভ, আবেগতাড়িত নয়।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাপ্তবয়স্কদের এবং এমনকি শিশুদের প্রথম স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ (first instinct) হলো অন্যদের প্রতি সহানুভূতি ও সমমর্মিতা।। গবেষকরা আরো দেখেছেন, বিশেষ করে চাপের বা বিপদের মুখে আমাদের প্রথম প্রৈতি(impulse) হয় অন্যকে সাহায্য করা,নিজের সুবিধা দেখা নয়.(সূত্র: Psychology today,৩, জুন, ২০১৩). আমরা মানুষকে যত স্বার্থপর, ভন্ড, নিষ্ঠূর বলি , আসলে তা নয়. এমন হলে অনেক আগেই মানব জাতি বিলীন হয়ে যেতো।
আমাদের বুক ভরা প্রেম ও ভালোবাসা আছে বলেই আমরা বেঁচে আছি . অন্যকে বিপদে পড়তে দেখলে আমাদের মন কেঁদে ওঠে সেই কারণে। আমাদের শক্তি আমাদের প্রেমের টান. কথাগুলো শুধু আবেগের নয়, বিজ্ঞান নির্ভর। এই কারণে মানুষ ভালোবেসে যুদ্ধে যেতে পারে, দেশের জন্য, জাতির জন্য নিজের জীবন দিতে পারে।
পৃথিবীতে কোটি কোটি বছর ধরে মানব সদৃশ অনেক প্রজাতির আগমন ঘটেছে। ৫০ হাজার কিংবা ৬০ হাজার বছর আগে পৃথিবীতে আধুনিক মানবজাতির আগমনের আগে মানুষের (homonin) মতো প্রজাতিগুলোর বিচরণ ছিল. এর মধ্যে Neanderthals আর Hobbit দুই জাতি আধুনিক মানুষের সমসাময়িক ছিলো।
এই জাতিগুলো আমাদের আগে এই পৃথিবীতে এসেছে, তাদের বুদ্ধিমত্তাও ছিল. তা সত্ত্বেও তারা একের পর এক বিলীন হয়ে গেছে। আমাদের পূর্বপুরুষদের সময়েও যারা বসবাস করেছিল, তারাও নিশ্চিন্ন হয়ে গেছে।
আমরা একমাত্র মানবজাতি টিকে আছি, আমরা একক প্রজাতি হিসাবে পৃথিবীর উপর আমাদের একচ্ছত্র শাসন প্রতিষ্ঠিত করেছি।
বিজ্ঞানীদের মতে, আমাদের বেঁচে থাকা সম্ভব হয়েছে কারণ আমাদের ভালোবাসা আছে. আমাদের আবেগ, অনুভূতি, সহানুভূতি ও মানবিকতা আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে।
পাথরে পাথর ঘষে আগুন ধরানো কিংবা পাহাড়ের গুহায় বসবাস করা, আমাদের বেঁচে থাকার কৌশল নয়. আমাদের বেঁচে থাকার কৌশল হলো সমাজবদ্ধ, গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে একত্রে থাকার কৌশল।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, আমাদের ভাবাবেগ বিনিময়ের দক্ষতা আমাদের শক্তি জুগিয়েছে। সে প্রথম থেকেই আন্তঃব্যাক্তিক থেকে আন্তঃসামাজিক পর্যায়েভাবাবেগ বিনিময় করা হতো.
এই জন্যেই আমরা আমরা “সবার উপর মানব সত্য”
মানুষের পরস্পরের প্রতি যে সহানুভূতি ও সমবেদনা মানুষ বিপদে একে অন্যকে বাঁচায়, একসাথে হয়ে বিপদ মোকাবেলা করে. বেঁচে থাকার এই কৌশল মানুষ জাতিকে আদিম কাল থেকে টিকিয়ে রেখেছে।
ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া সমবেদনা ও সহানুভূতি কোথা থেকে, কিভাবে আসে, তার উপর গবেষণা হয়েছে। সমবেদনার বৈজ্ঞানিক অর্থ হলো, বেদনা অনুভূতির প্রতিবিম্ব। আমরা যখন একজন মানুষের বেদনা দেখি, আমরা তা উপলব্ধিও করি. অন্যের বেদনার প্রতিবিম্ব আমাদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়. এই সহানুভূতি ও সমবেদনা আমাদের শক্তি যোগায়। এই শক্তি আমাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন। সমবেদনা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি যা ভেতর থেকে আসে.
বিজ্ঞানীরা অন্য প্রাণীদের মধ্যেও সহানুভূতির সন্ধান পেয়েছেন, কিন্তু তা খুবই অপর্যাপ্ত।
আবেগ, অনুভূতি ও মানবিক মূল্যবোধ আমাদের দুর্বলতা নয়, আমাদের সবলতা। এই অনুভূতিগুলো আমাদের যোগ্যতম প্রজাতি হিসাবে টিকিয়ে রেখেছে।
স্বার্থপরতা দিয়ে আমরা এই পর্যায়ে আসতে পারতাম না. আমরা একক ভাবে বেঁচে থাকি না, সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে বেঁচে থাকি। আমরা যেমন নিজেদের নিয়ে কম ভাবি, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে আরো বেশী ভাবি। আমাদের কামনা “ আমাদের সন্তানেরা যেন দুধে ভাতে থাকে”. আমরা যদি শুধু শুধু আমাদের নিয়ে ভাবতাম, তাহলে নিজেদের জীবন উপভোগ করতাম। বৈশ্বিক উষ্ণতা সম্পর্কে ভাবতাম না, পরিবেশ নিয়ে ভাবতাম না. প্রকৃতিকে ধ্বংস করে নিজেরা সবকিছু উপভোগ করতাম।
আমরা নিজেরা নিজেদের স্বার্থপর বলে যত গালি দেই , আসলে আমরা ওতো স্বার্থপর নই. আমাদের পূর্বসূরিরাও নিঃস্বার্থভাবে আমাদের কল্যাণ চিন্তা করতেন। এই কারণে মানবসভ্যতার অবিরত ধারা বজায় আছে.
মানবজাতির সমজাতীয় প্রজাতিগুলো “হোমিনিন” গোষ্ঠীর মধ্যে পরে. এই হোমিনিন প্রজাতিগুলোরও বুদ্ধিমত্তা ছিল. কিন্তু তাদের আমাদের মতো আবেগ, অনুভূতি ছিল না. টিকে থাকতে আবেগ, অনুভূতির দরকার হয় যা শুধু হোমো সেপিয়েন্স অর্থাৎ আমাদের আছে. আমরা শ্রেষ্টতম শুধু বুদ্ধির কারণে নয়, আবেগের কারণেও। আমাদের বন্ধুত্ব, সামাজিকতা ও ভালোবাসার বন্ধন, আমাদের ঢালের মতো রক্ষা করেছে।
হোমিনিন গোষ্ঠীভুক্ত Neanderthals আর Hobbit এই প্রজাতি সম্পর্কে আমরা বেশি জানি। অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক প্রাপ্তি এই দুই প্রজাতি সম্পর্কে ভালো ধারণা দেয়. এরা দুই লক্ষ বছর আগে পৃথিবীতে এসেছে। ৩০ হাজার বছর আগে,( কিছু বিজ্ঞানীর মতে ১৭ হাজার বছর) পর্যন্ত পৃথিবীতে তাদের অস্তিত্ব ছিল.
তাদের শিকার করার কৌশল ও অস্ত্রগুলো খুব উন্নত মানের ছিল. তারা শীতবস্ত্র তৈরী করতে পারতো। এমনকি নিজেদের বাড়ীও বানাতো।
অন্যান্য হোমিনিন প্রজাতি আধুনিক মানুষ আসার অনেক আগে বিলীন হয়ে গেলেও। Neanderthals and the “Hobbit প্রজাতি মানুষ থাকা কালেও ছিল. মানুষ তাদের জায়গা দখল করেছে। আমাদের পূর্বসূরিদের আৱিৰ্ভাগ যখন আফ্রিকাতে হয়েছিল, তখন ইউরোপে তাদের বিচরণ ছিল. ৩০ হাজার বছর মানবজাতি ইউরোপে এসে তাদের অপসারণ করেছে।
যারা এতো লক্ষ বছর ধরে পাকাপোক্তভাবে এই গ্রহে বসবাস করছে, আমাদের পূর্বসূরিরা তাদের কিভাবে হটিয়ে দিতে পারলো?
এই প্রশ্নের উত্তর জার্মান গবেষক নিকোলাস কোনার্ড দিয়েছেন। জার্মানীর টুবিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের(University of Tübingen) উদ্যোগে জার্মানীর বিশেষ এলাকার পুরাতন গুহা সমূহে ব্যাপক প্রত্নতাত্ত্বিক সার্ভে করা হয়. সার্ভের উদ্দেশ্য ছিল, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের যৌথ প্রচেষ্টায় ভিত্তিতে মানুষের আদি যুগের জীবনধারা সম্পর্কে অবহিত হওয়া। এই গবেষণা দলের নেতৃত্ব দেন নিকোলাস কোনার্ড।
জার্মান গবেষকগণ ৪০ হাজার বছর আগেও মানব সমাজে (আধুনিক মানব প্রজাতি) কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও চারুকলার অস্তিত্ব খুঁজে পান. কোনার্ডের মতে, এগুলোই আমাদের পূর্বপুরুষদের অন্যান্য মানবসদৃশ প্রজাতির থেকে আলাদা করেছিল। মানুষ ওই সময় ছোট ছোট সমাজে বিভক্ত ছিল. মানুষ নিজেদের সমাজে যোগাযোগ করতে পারতো আর আন্তঃসামাজিক যোগাযোগও ছিল. এই যোগাযোগ হতো শিল্পকর্মের মাধ্যমে। বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন গুহায় একই ধরণের ভাস্কর্যের সন্ধান মিলেছে।
ওই সময় সংগীত ছিল. একই ধরণের বাজনার উপকরণ বিভিন্ন এলাকাতে পাওয়া গেছে। আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা ছাড়া সংগীত ও শিল্পকলা সম্ভব না.
আদিম মানুষ একত্রিত হতে পেরেছিলো ভালোবাসা, সহানুভূতি, সমমর্মিতার কারণে। ওই সময় মানুষ টিকে থাকে পেরেছিলো একত্রে থাকার কারণে। অন্যান্য জন্তু জানোয়ারের হাত থেকে বাঁচা ও শিকার করা সম্ভব হয়েছিল সংগবদ্ধভাবে আত্মরক্ষা ও প্রতি আক্রমণের মাধ্যমে।
Neanderthals এর মধ্যে আমাদের মতো আবেগ ছিল না. তারা আমাদের মতো ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অন্যদের বাঁচাতে না.
মানুষ আদিম যুগেও জ্ঞান নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে রাখেনি। বিভিন্ন গোত্রে ছড়িয়ে দিয়েছিলো। এক প্রজন্মের জ্ঞান অন্য প্রজন্মে বাহিত হয়েছে। চারুকলা ও ভাস্কর্যের মাদ্ধমে তা সম্ভব হয়েছে।
সন্তানের প্রতি স্নেহ মমতা কারণে মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। অন্যানো প্রজাতিগুলো ধীরে ধীরে মানুষের কাছে পরাজিত হয়েছে।
গত বছর আরিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে Origins of Human Uniqueness and Behavioral Modernity অর্থাৎ মানুষের মানুষের স্বকীয়তা ও সহজাত চরিত্রের আধুনিকতা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়. এই সম্মেলনের প্রধান আলোচ্য বিষয়বস্তু ছিল “হোমিনিন প্রজাতিগুলোর মধ্যে মানুষের টিকে থাকার কারণ নির্ণয়”. সম্মেলনে সব শাখার খ্যাতনামা বিজ্ঞানীরা অংশ নেন.
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্দালয়ের অধ্যাপক রব বয়েড বলেন, মানুষ এক সুমদ্রে নৌকা চালিয়ে বাঁচতে পারে না. আলাস্কার তুষারের মধ্যে কিংবা আরবে মরুভূমিতে বেঁচে থাকতে প্রয়োজন সংগবদ্ধতা
মানুষের মধ্যে ভালোবাসা আছে বলেই সংগবদ্ধ হওয়া সম্ভব। আমাদের সংস্কৃতি আমাদের বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছে। আবেগ, অনুভূতি সংস্কৃতির জন্য আবশ্যক। ভালোবাসা না থাকলে কবিতা লেখা যায় না.
আমাদের মানবিক মূল্যবোধ, প্রথম থেকেই ছিল. মূল্যবোধগুলো যুগে যুগে বিকশিত হয়েছে। এই মূল্যবোধ থেকে পারস্পরিক সহযোগীতা শুরু হয়েছে। পারস্পরিক সহযোগিতা যত বেড়েছে, মানব সভ্যতা ততই বিস্তার লাভ করছে।
গত দুই দশকের বিশ্বায়নের ফলশ্রুতিতে আমাদের জীবন যাত্রার মানের লক্ষণীয় উৎকর্ষতা সাধন হয়েছে। বিগত সহস্র বছর ধরে তা সম্ভব হয়নি। আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতা যত বাড়বে, আমরা ততই এগিয়ে যাবো।
আমাদের জ্ঞান ও তথ্য আদিম কালেও আদিম পদ্ধতিতে ছড়িয়ে দেওয়া হতো. এখন আমরা এক সেকেন্ডে আমাদের জ্ঞান ছড়িয়ে দিচ্ছি। এই কারণে আমাদের প্রগতির উল্লম্ফন ঘটেছে।
আমরা নিজেকে বাঁচাই, অন্যকেও বাঁচাই। অনেক সময় নিজেদের জীবন দিয়েও অন্যকে বাঁচাই। আমরা মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়ে আমাদের দেশকে বাঁচাই।
আদিম কালে একটা সিংহ মানুষকে আক্রমণ করলে, সব মানুষ লাঠি শোঠা নিয়ে এগিয়ে আসতো তাকে বাঁচাতে। আমরা এখনো সেরকমই করি. দুর্গম গুহায় কোন মানুষ আটক পড়লেও , অন্যেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের বাঁচায়।
পারস্পরিক সহযোগীতা দিয়ে আমরা যেমন একজন ব্যাক্তিকে বাঁচাই আবার একটা জাতিকেও বাঁচাই। এইভাবে আফ্রিকার ক্ষুধার্ত মানুষ বেঁচে থাকে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরও আমরা বাঁচাই।
সকল আবেগের উৎস আমাদের ভালোবাসা। আমাদের ভালোবাসা আমাদের সন্তানদের জন্য, আমাদের প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য, মানব জাতির জন্য। এই ভালোবাসা যুগে যুগে আমাদের শক্তি জুগিয়েছে।
মানুষের মধ্যে হিংসা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতার মতো নেতিবাচক আবেগ আছে. কিন্তু সেগুলো কখনোই ভালোবাসা, সহমর্মিতা, সহৃদয়তা সর্বোপরি মনুষ্যত্বকে ছাপিয়ে যায় না. তাই আমরা বেঁচে আছি,টিকে আছি।